কসাই থেকে ডাক্তার : ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল, খুলনা - সত্য ঘটনা
মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার মধ্যে চিকিৎসা অন্যতম। আর সেই চিকিৎসা নিয়ে শুরু হয়েছে রমরমা ব্যবসা। ছোট বেলা থেকে বড়দের মুখ থেকে এবং বিভিন্ন সংবাদ চ্যানেলের মাধ্যমে শুনে আসছি যে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা ভালো নয়।বাংলাদেশের ধনীরা চিকিৎসার জন্য যায় সিঙ্গাপুর, আমেরিয়া বা অন্যান্য উন্নত রাষ্ট্রগুলো।অন্যদিকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ চিকিৎসার যায় ভারতে। বিভিন্ন সময়ে ভারতীয় মিডিয়ায়ও একথা বলা হয় যে, ভারতের চিকিৎসার না দিলে বাংলাদেশের অনেক মানুষ চিকিৎসার অভাবে মারা যাবে। যা অনেক সিনেমার মাধ্যমেও ভারত গৌরব প্রকাশ করে থাকে।কিন্তু একটা প্রশ্ন আমার মনে সব সময়ই ছিল যে, বাংলাদেশের মানুষ ভারতে চিকিৎসার জন্য এত যায় কেন? বাংলাদেশে তো অনেক বড় বড় হাসপাতাল আছে। সেখানে চিকিৎসা নিলেও হয়। এই প্রশ্নের উত্তর যত বড় হচ্ছি তত বেশি ভালো করে জানতে পারছি। শুধু জানতে নয় হাড়ে হাড়ে বুঝতেও পারছি।বিভিন্ন সময় শুনেছি : একটি লোক বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়েছে, ভুরি ভুরি টেস্ট করিয়েছে, একই টেস্ট বার বার করেছে। শেষ পর্যন্ত ডাক্তার বলেছে যে, টিউমার হয়েছে অপারেশন করতে হবে।মুটামুটি অনেক টাকাই লাগবে। পরবর্তীতে সেই লোক ভারতে একটি হাসপাতালে গিয়ে জানতে পারে তার কোন টিউমার নই, গ্যাস হয়েছে। ভারতে হাসপাতাল থেকে কিছু ঔষধ লিখে দিয়েছে রোগী তাতে সুস্থ হয়ে গেছে। আরেকজন লোকের মাথায় ব্রেন টিউমার হয়েছিল। বাংলাদেশের ডাক্তার তাকে 1 মাসের সময় দিয়েছিল। সেই লোক ভারতের বেঙ্গালুর থেকে ডাক্তার দেখিয়ে এখন 2 বছরের বেশি সময়ে হয়ে গেছে সেই লোক এখনও সুস্থ। এর রকম আরও অনেক ঘটনা আছে যা শুধু মাত্র গ্রামের মানুষের সাথে হয়ে চলেছে। সেই সকল রোগীদের নিকট থেকে শোনা কথা যারা প্রথমে বাংলাদেশ থেকে চিকিৎসা নিয়েছে পরে ভারত থেকে তাদের সকলের একটাই কথায় ভারতে ডাক্তাররা বাংলাদেশের থেকে অনেক ভালো চিকিৎসা ও ব্যবহার ভালো করে। খরচও বাংলাদেশের থেকে কম এবং হয়রানীও কত হতে হয়।কিন্তু বাংলাদেশের অবস্থা তার উল্টো।যার স্বাক্ষী আমি নিজেই।
ঘটনাটি ঘটেছে গত ০৪/০১/২০২৫ তারিখ সময় দুপুর ১২:০০ টার আশে পাশে পুকুরে গোছল করতে গিয়ে আমার আব্বু স্ট্রোক করে।আশে পাশে থাকা মানুষ আব্বুকে নিয়ে বাড়ী পৌছে দিয়ে গেল। আব্বু স্ট্রোক করার ৩০-৪৫ মিনিটের মধ্যে আব্বুকে ইজিবাইকে করে উপজেলা জেলা হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। হাসপাতাল থেকে ইনজেকশন দিয়ে বলা হলো জেলা হাসপাতালে নিয়ে যেতে। আমরা আর্থিক ভাবে অস্বচ্চল থাকায় ও কিছু মানুষের উপদেশে ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল, খুলনাতে নিয়ে গেলাম। সময়টা আনুমানিক ২:০০ টা হবে। যাওয়ার সাথে সাথে ভর্তি করা হলো। বলা হলো টেস্ট করতে হবে সেগুলো করে নিয়ে আসো। টাকা লাগবে ৪,০০০/- শুনেই তো মাথায় হাত বলে কি। তারপর বলা হলো আব্বুকে নিজেদের টাকা খরচকে গাড়ি ভাড়া দিয়ে নিয়ে যেতে হবে ল্যাবে এবং টেস্ট এর পর নিজেরাই আবার নিয়ে আসতে হবে। এমতাবস্থায় এত টাকা কোথায় পাব এবং যদি শুধু একটি টেস্ট করতেই সরকারি হাসপাতালে এতখরচ হয় তাহলে বাকি খরচ তো পড়েই রইল।এই সব চিন্তা করতে করতে একজন অ্যাম্বুলেন্স চালক বলল ২,০০০/- টাকা দিলে যে নিজ খরচে আব্বুকে নিয়ে গিয়ে টেস্ট করিয়ে আবার নিজ দায়িত্বে দিয়ে যাবে। এমতাবস্থায় যেহেতু অর্ধেক-এ কাজটি অনেকটা সহজে করা যাচ্ছে তাই ঐ অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভারকে বললাম টেস্টটি করিয়ে আনতে।আব্বুকে নিয়ে উঠলাম অ্যাম্বুলেন্সে। হাসপাতাল থেকে প্রায় ৫-১০ কিলোমিটার দূরে গিয়ে টেস্ট করিয়ে ফিরে আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যায়।ল্যাব সেন্টারের নাম : Bright Diagnostic & Consultation Center, Islampur Road, (Satrastar More), Khulna, Mob : 01997-500600 (রিসিট থেকে পাওয়া) কিন্তু রিপোর্ট দিবে পরে। কি আর করা টেস্ট রিপোর্ট নেওয়ার জন্য মামা সেই ল্যাবে বসে রইল এবং আব্বুকে নিয়ে আমি হাসপাতালে চলে আসলাম।২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল, খুলনা হাসপাতালের খুবই খারাপ অবস্থা। বেড পেলাম না। বারান্দায় থাকতে হবে।কিন্তু বারান্দায়ও প্রচুর লোক।ফাকা জায়গা দেখে এগিয়ে গেলে সেখানে পাশে থাকা অন্যলোকরা ঐ ফাকা জায়গায় পা দিয়ে দিয়ে বলতে লাগল জায়গা দখল হয়ে আছে, কেউ কেউ তাদের জিনিস পত্র দিয়ে জায়গা দখল করে রাখতে লাগল। এবার ৩/৪ বার হলো।তারপর বারান্দার এককোণায় জায়গা হলো। শীতের রাত, সরু বারান্দা।বারান্দা দিয়ে প্রতিনিয়ত মানুষ চলাচল করছে। চেচামেচি, উচ্চ শব্দ, রাস্তায় গাড়ির হর্ণ, শীতের ঠান্ডা বাতাসে যেন এক অসহ্য যন্ত্রণা হতে লাগল।আমার কাছে যেন এই রাতটা জীবনের খুবই কষ্টদায়ক রাত হতে যাচ্ছে মনে হলো।হাসপাতালে গিয়েই জানতে পেরেছিলাম বড় ডাক্তার নেই।বড় ডাক্তার ২:০০-৩:০০ টা পর্যন্ত থাকে।তারপর ছোট ছোট ডাক্তার ও হাসপাতালের কর্মীরা থাকে যারা হালকা পাতলা প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে থাকে পরের দিনের বড় বা প্রধান ডাক্তারদের জন্য।আমরা যেহেতু শনিবারে গিয়েছিলাম সেহেুত ঐদিন ডাক্তার আসেননি।এখন প্রশ্ন আসতে পারে শুক্রবার-শনিবার বা সরকারি ছুটির দিন ডাক্তার না আসলে রোগীরা কিভাবে বাচবে। যদি গুরুতর কিছু হয় তাহলে কি হবে সেই রোগীদের? উত্তর হলো ছোট ছোট ডাক্তার নামে কষাই রয়েছে ও হাসপাতালের বিভিন্ন দালাল রয়েছে তারা এই সময়ে রোগী ও রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে বিভিন্ন টেস্ট, পরীক্ষা ও ঔষধ প্রেসক্রিপশনে লিখে রোগীকে খাওয়াতে থাকে এবং রোগীদের কাছ থেকে চড়া মুল্য নিতে থাকে।এযেন এক ভয়াবহ চিত্র।তারপর একজন মেডিকেল ইন্টার্নি করা ছাত্র ডাক্তারের কাছ থেকে শুনলাম নাকি বড় বড় ডাক্তাররা আবার মাঝে মাঝে ছুটি ছাড়াই আসেন না। শুনে তো আমার গলা শুকিয়ে যেতে লাগল।আব্বুকে যেহেতু দুপুরের একটু আগে নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছি সেহেতু আমি গোসলও করতে পারি নি। উপজেলা হাসপাতালে দেখাব বলে প্রথমে সিদ্ধান্ত হওয়ায় বেশি শীতের কাপড়ও আনা হয়নি। রাত ১০:০০টার বেশি বাজে। মামা এখনও ল্যাব থেকে টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে আসে নি। এদিকে কোন ডাক্তারও আব্বুকে দেখতে আসেনি। স্ট্রোক করার পর এখন পর্যন্ত ১১-১২ ঘন্টা পার হয়ে গেছে। শুধু মাত্র উপজেলা হাসপাতাল থেকে একটি ইনজেকশন ছাড়া কোন প্রকার চিকিৎসা তাকে এখনও দেওয়া হয়নি।এই হাসপাতাল ২৫০ বেড হলেও এখন তা ৫০০+ বেডে উর্নীত হয়েছে। তারপরও বেড খালি নেই, মানুষ বারান্দা, ফ্লোরে যেখানে সেখানে পড়ে আছে চিকিৎসার অবহেলায়।সিদ্ধান্ত নিলাম প্রাইভেট হাসপাতালে যাই কিন্তু সকলে বলল প্রাইভেট হাসপাতালে শুধু একরাতের বেড ভাড়া ৩০০০/- টাকা। এছাড়া ডাক্তার খরচ অনেক, টেস্ট করতে তো আরও বেশি খরচ। এমতাবস্থায় কি করব বুঝতে পারছিলাম না। এদিকে মামাও রিপোর্ট নিয়ে আসছে না।এভাবে এক ভয়াবহ সময় পার করতে লাগলাম।কোন এক অজানা ভয় ও দুঃচিন্তা মাথার মধ্যে ঘুর পাক খেতে লাগলো। রাত ১২:০০ টার দিকে মামা আসল। মামা এসে বলল ল্যাবের লোকজন বলছে যে, টেস্ট করার সময় সমস্যা হয়েছে আবার টেস্ট করার লাগবে। এখন টেস্ট করতে ২৩০০/- টাকা লাগবে।ল্যাবের লোক একটি কার্বন কপি দিয়েছে। অর্জিনাল কপি নিয়ে লাভ হবে না, রিপোর্ট নাকি ঘোলা হয়ে গেছে।একজন লোক ফোন দিয়ে ল্যাবের লোকদের ধমক দিলে তারা বলল তাহলে সকালে নিয়ে যান।কার্বন কপি নিয়ে সাথে সাথে রিপোর্ট নিয়ে দৌড়ে গেলাম দায়িত্বরত প্রাথমিক চিকিৎসা দানকারী ডাক্তার ও স্টাফদের কাছে। তারা ডাক্তার নাকি দালাল জানি না। রিপোর্ট হাতে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে বলল : এই রিপোর্টে হবে না, এই রিপোর্ট আমরা বুঝতে পারছি না । কাল সকাল ৯:০০ টার মধ্যে বড় ডাক্তার আসবে তার আগে আবার ল্যাব থেকে টেস্ট করে আনো। মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়। রাত ১২:৩০ টা বাজে এখন বলে এই রিপোর্ট এ হবে না।কি করব বুঝতে পারছিলাম না।সিদ্ধান্ত নিলাম আগামী কাল সকাল ভোরে এসে হাসপাতাল স্টাফদের কাছে ৪০০০/- টাকা দিয়ে বলল আপনারা রিপোর্ট করিয়ে এনে দিন যাতে আমাদের হয়রানির শিকার হতে না হয় অসুস্থ আব্বুকে নিয়ে।আম্মু সন্ধ্যার সময় বাড়ি চলে গেছে। মামা রাত 12:00 টার সময় বাড়ি চলে গেলেন। আমি আর আম্মু শীতের রাতে হাসপাতাল নামক জাহান্নামের প্রতিরুপ ঘরে বসে রইলাম।সকাল হলো।সেদিন ররিবার। ডাক্তার আসার দিন। মামা ও আম্মু এখনও আসেনি। তাই রিপোর্ট নতুন করে করতে যেতে পারি নি।এর মধ্যে ৯:০০ টার দিকে প্রধান ডাক্তার আসলো।দূর থেকে দাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল সমস্যা সম্পর্কে। তাড়াতাড়ি যত টুকু বলার বললাম। কার্বন কপিটি নিয়ে দেখে বলল আর কিছু লাগবে না।কিছু ঔষুধ লিখে দিল ইন্টার্ণি এক ডাক্তার এবং বলল বাড়ি গিয়ে ম্যাসেজ কর।হয়ে গেল চিকিৎসা। আম্মু মিনি স্ট্রোক করেছে। তিনি ডান পাশে কম বল পাচ্ছেন।তিনি নিজে নিজে হাটতে গেলে পড়ে যাচ্ছেন। তার চিকিৎসা কয়েকটি ঔষধ ও বাড়ি নিয়ে ম্যাসেজ করো। যাই হোক এই বারের মতো বাড়ি চলে আসলাম। ল্যাব থেকে রিপোর্টটি আনলাম না । ভাবলাম যেহেতু বেশি কিছু হয়নি তাই বাড়ি চলে আসলাম অর্জিনাল রিপোর্ট না নিয়ে। কিন্তু 1/2 দিন পরে ভাবলাম যেহেতু ডাক্তার ঠিকমতো চিকিৎসা নেননি সেহেতু কোন প্রাইভেট হাসপাতাল থেকে রিপোর্টটি ভালো করে দেখিয়ে ভালো করে চিকিৎসা নিব। তাই রিপোর্টের স্লিপ ও কার্বন রিপোর্টটি নিয়ে পুনরায় Bright Diagnostic & Consultation Center, Islampur Road, (Satrastar More), Khulna উক্ত ল্যাবটিতে গেলে তারা সকাল থেকে বিকাল ৪:০০ টা পর্যন্ত বসিয়ে রেখে বলল, “রিপোর্ট দেওয়া যাবে না। রোগীকে নিয়ে এসে আবার টাকা খরচ করে টেস্ট করুন। তারপর রিপোর্ট পাবেন।" এই বলে আমাকে ল্যাব থেকে চলে যেতে বলল।আমি হত বাকের মতো বের হয়ে আসলাম।
কথোপকথনে যোগ দিন